পাবনার সূর্যসন্তান: দুই ভাইয়ের আইন, রাজনীতি আর জনকল্যাণের কাব্য একটি সত্যভিত্তিক ঐতিহাসিক উপাখ্যানলিখেছেন: মঈন কাদেরী
প্রকাশকাল: ৪ জুন ২০২৫
পাবনার সাথিয়া থানার প্রাচীন জনপদ শাথবিল। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান ইছামতি নদী যেন ভূমির শিরায় রক্তস্রোতের মতো কৃষিকে সঞ্জীবিত করে। বর্ষায় টলমলে জল, শীতে ক্ষীণ স্রোত; কিন্তু তার প্রাচীনতা আর আশীর্বাদ এক। এখানেই ১৮৭২ সালের এক শীতার্ত প্রভাতে জন্ম নিলেন দুই আলোকবর্তিকা ভাই—মৌলভী আজহার আলী মিঞা ও মৌলভী আফসার আলী মিঞা।
তাঁদের শৈশব কেটেছে নদীর ধারে তাল-গাছ ছায়াতলে, ধানের মাঠ আর মসজিদের হিফজখানা ঘিরে। পরিবারের ঐতিহ্য ছিল গভীর শিক্ষায় প্রোথিত—আরবি, ফারসি ও বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ এক গৃহগ্রন্থাগার ছিল তাঁদের পিতা মৌলভী কাদের বখশ মিঞার গর্ব। ছোট থেকেই ভাই দু’জনকে শেখানো হয়েছিল—“জ্ঞান হলো ইবাদত, আর ন্যায় হলো ঈমানের স্তম্ভ।”
তাঁরা আরবি ও ফারসি শেখেন স্থানীয় ওস্তাদদের কাছে, পরে পাবনার সেমিনারি স্কুল ও কলকাতা মাদ্রাসা-কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার দিনে একজন মুসলমান যুবকের জন্য কোর্ট-কলেজে আইন পড়া মানে ছিল অভিজাতদের বিশ্বে প্রবেশ—কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। তাঁরা গিয়েছিলেন দরিদ্র কৃষকের হয়ে বিচার-অঙ্গনে দাঁড়াতে।
পরে তাঁরা কলকাতা হাইকোর্ট ও পাবনা জেলা জজ কোর্টে সমান দক্ষতায় আইনচর্চা করেন। জনশ্রুতি রয়েছে—“যখন মৌলভী আজহার সাহেব কোর্টে উঠতেন, প্রতিপক্ষ জমিদার পক্ষ নিজেই ভয়ে মাথা নিচু করত।”
১৮৯৩ সালের এক বর্ষার রাতে, শালগাড়িয়ায় তাঁদের পারিবারিক বাড়ির পেছনের টিনের চালে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সেই রাতে এক জরুরি সভায় তাঁরা বলেন—“চাষির ঘামে জমি ফললেও, মুনাফা তো চলে যায় জমিদারের থালায়। এবার দরকার আইনি-রাজনৈতিক প্রতিরোধ।” এরই ফল হিসেবে ১৮৯৪ সালের ১৭ আগস্ট গঠিত হয় পাবনা কৃষক সমবায় সমিতি (Pabna Farmers’ Cooperative Society)।
এই সমিতি ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম প্রথম বৈধ কৃষক সংগঠন, যার প্রতিষ্ঠাকালে সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন পেশার কৃষক, যাঁরা নিজেদের জমি ও অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে মৌলভী আজহার আলী ও মৌলভী আফসার আলী ছিলেন মূল নেতৃত্ব, যারা কৃষকদের জন্য আইনি সহায়তা ও আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
এই সমিতি নিছক একটি সংগঠন ছিল না—তা ছিল কৃষকের মুখে কথা, চোখে স্বপ্ন, আর বুকে সাহস জোগানোর এক সামাজিক আন্দোলন। জমির পাট্টা বুঝিয়ে দেওয়া, ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তির কৌশল শেখানো, চাষের জন্য মাইক্রো ঋণ চালু করা, এমনকি তাঁতশিল্প পুনরুজ্জীবন—সব কিছু এই দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।
১৮৯৬ সালে একটি ঐতিহাসিক মামলা ‘রায়চৌধুরী বনাম জমিদার’-এ মৌলভী আজহার আলী চাষিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন—
“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া একতরফা সিদ্ধান্ত, যা রাজনীতি ও মানবতাবিরোধী।”
এই মামলার রায় ছিল এক বিপ্লব—Bengal Law Reports (Vol. XV, 1896)–এ তা প্রকাশিত হয়। The Calcutta Gazette (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭) লিখেছিল—
“This verdict was not just a legal win—it was the declaration of peasant dignity.”
১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও তাঁদের কর্মফল স্পষ্ট হয়। মৌলভী আজহার আলী মুসলিম সংরক্ষিত আসনে জয়ী হয়ে আইনসভার সদস্য (MLA) মনোনীত হন। তাঁর ভাষণে উঠে আসে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ, কৃষি শিক্ষা, খাজনা রেহাই, এবং ভূমি অধিকার সংক্রান্ত বিলের খসড়া।
একই সময়ে মৌলভী আফসার আলী হয়ে ওঠেন মাঠের নায়ক। ১৯৩৮ সালের রেকর্ডে পাবনা মুসলিম সাহিত্য সংসদে তাঁর নেতৃত্বে ২০০-র অধিক কৃষক সমবায় গঠন হয়। তাঁকে বলা হতো—“শিক্ষা, সভ্যতা ও শ্রমের পথপ্রদর্শক।”
২০০৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে প্রবীণ কৃষক মোঃ আলী হাসান বলেন—
“তাঁরা শুধু আইন জানতেন না—তাঁরা আইন দিয়ে ভালোবাসা শিখিয়েছেন।”
তাঁদের পারিবারিক বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে পাবনা শালগাড়িয়া ও সাথিয়া এলাকার মাটিতে, পাশাপাশি কলকাতার ভিক্টোরিয়া রোডেও। এই দুই স্থানেই সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে রাখা আছে তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন, যা নতুন প্রজন্মের জন্য ন্যায় ও কৃষিজীবনের সংগ্রামের এক জীবন্ত উদাহরণ।
⸻
ঐতিহাসিক প্রমাণ ও রেফারেন্স:
1. Bengal Law Reports, Vol. XV, 1896
2. The Calcutta Gazette, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭
3. Star of India, ১৩ জুলাই ১৯৩৭
4. Pabna Muslim Literary Society Archives, 1938
5. মৌখিক ইতিহাস সাক্ষাৎকার: মোঃ আলী হাসান, ২০০৩
6. Eaton, R. – The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1993
7. Hardgrave, R. – Peasant Resistance in Colonial India, 1969
⸻
শেষকথা:
মৌলভী আজহার আলী ও আফসার আলী কেবল দুই ভাই ছিলেন না—তাঁরা ছিলেন বাংলার আইন, শিক্ষা ও মানবিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। তাঁদের গল্প নদীর মতো প্রবহমান, যা একাধারে ইতিহাসের দলিল, সমাজের আয়না, আর ভবিষ্যতের পথনির্দেশ।